কোন মাসে কোন সবজি ও ফল চাষ করবেন

ভূমিকা

বাংলাদেশে ছয় ঋতু বৈচিত্র্যের কারণে বিভিন্ন মৌসুমে নানা ধরনের সবজি ও ফল চাষ করা হয়। আমাদের দেশের কৃষিকাজ মূলত খরিফ-১, খরিফ-২ ও রবি মৌসুমে বিভক্ত হলেও, প্রকৃতির পরিবর্তনের সাথে সাথে বিভিন্ন সময়ে চাষাবাদ করা হয়। সঠিক সময়ে সঠিক ফসল চাষ করলে তা থেকে সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া সম্ভব। এই নিবন্ধে আমরা আলোচনা করব, কোন মাসে কোন সবজি ও ফল চাষ করা উচিত এবং তা কীভাবে আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

 

বিভিন্ন ফলের উপকারিতা

আম

আম গ্রীষ্মকালে খুবই জনপ্রিয় ফল। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, এ, এবং ই। আম খেলে হজমশক্তি বৃদ্ধি পায় এবং ত্বকের জন্যও উপকারী।

কলা

কলা সারা বছর পাওয়া যায়। এতে রয়েছে প্রচুর পটাশিয়াম যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং হাড়ের গঠন মজবুত করে।

লিচু

লিচু গ্রীষ্মকালে পাওয়া যায়। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। লিচু খেলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ে।

 

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফলের জনপ্রিয়তা

রাজশাহী

রাজশাহী অঞ্চলে আমের চাষ সবচেয়ে বেশি হয়। এখানকার মাটি ও আবহাওয়া আমের জন্য উপযুক্ত। এখানকার আম সারা দেশে বিখ্যাত।

 

দিনাজপুর

দিনাজপুরে লিচুর চাষ অনেক বেশি হয়। এখানকার লিচু খুবই মিষ্টি এবং রসালো।

 

রংপুর

রংপুরে কাঁঠালের চাষ ব্যাপকভাবে করা হয়। এখানকার কাঁঠাল খুবই সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর।

 

বিভিন্ন মাসে ফল চাষের তালিকা

বৈশাখ (মধ্য এপ্রিল-মধ্য মে):

  • লালশাক, গিমাকলমি, ডাটা, পাতাপেঁয়াজ, পাটশাক, বেগুন, মরিচ, আদা, হলুদ, ঢেঁড়স বীজ বপনের উত্তম সময়।
  • গ্রীষ্মকালীন টমেটো চারা রোপণ করা যায়।
  • মিষ্টিকুমড়া, করলা, ধুন্দুল, ঝিঙা, চিচিংগা, চালকুমড়া, শসা-র মাচা তৈরি ও চারা উৎপাদন।
  • কুমড়া জাতীয় সবজির পোকা-মাকড় দমন ও সেচ প্রদান।
  • খরিফ-১ মৌসুমের সবজির বীজ বপন ও চারা রোপণ, ডাটা, পুঁইশাক, লালশাক, বরবটি ফসল সংগ্রহ।
  • খরিফ-২ সবজির বেড ও চারা তৈরি।
  • কচি শজিনা, তরমুজ, বাঙ্গি সংগ্রহ।
  • ফল চাষের স্থান নির্বাচন, উন্নত জাতের ফলের চারা বা কলম সংগ্রহ, পুরনো ফল গাছে সুষম সার প্রয়োগ ও ফলন্ত গাছে সেচ প্রদান।

 

জ্যৈষ্ঠ (মধ্য মে-মধ্য জুন):

  • আগে বীজতলায় বপনকৃত খরিফ-২ এর সবজির চারা রোপণ, সেচ ও সার প্রয়োগ ও পরিচর্যা।
  • শজিনা সংগ্রহ এবং গ্রীষ্মকালীন টমেটো চারা রোপণ ও পরিচর্যা।
  • ঝিঙা, চিচিংগা, ধুন্দুল, পটল, কাকরোল সংগ্রহ ও পোকা-মাকড় দমন।
  • নাবী কুমড়া জাতীয় ফসলের মাচা তৈরি, সেচ ও সার প্রয়োগ।
  • ফলের চারা রোপণের গর্ত প্রস্তুত, বয়স্ক ফল গাছে সুষম সার প্রয়োগ, ফলন্ত গাছের ফল সংগ্রহ এবং বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা।

 

আষাঢ় (মধ্য জুন-মধ্য জুলাই):

  • গ্রীষ্মকালীন বেগুন, টমেটো, কাঁচা মরিচের পরিচর্যা, শিমের বীজবপন, কুমড়া জাতীয় সবজির পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন।
  • আগে লাগানো বেগুন, টমেটো ও ঢেঁড়স থেকে ফসল সংগ্রহ।
  • খরিফ-২ সবজির চারা রোপণ ও পরিচর্যা, সেচ, সার প্রয়োগ।
  • ফলসহ ওষুধি গাছের চারা বা কলম রোপণ, খুঁটি দেয়া, খাঁচা বা বেড়া দেয়া ও ফল গাছে সুষম সার প্রয়োগ।

 

শ্রাবণ (মধ্য জুলাই-মধ্য আগস্ট):

  • আগাম রবি সবজি যেমন বাঁধাকপি, ফুলকপি, লাউ, টমেটো, বেগুন এর বীজতলা তৈরি ও বীজ বপন।
  • খরিফ-২ এর সবজি উঠানো ও পোকামাকড় দমন।
  • শিমের বীজ বপন, লালশাক ও পালংশাকের বীজ বপন।
  • রোপণকৃত ফলের চারার পরিচর্যা, উন্নত চারা/কলম রোপণ, খুঁটি দেয়া, খাঁচা বা বেড়া দেয়া, ফলন্ত গাছের ফল সংগ্রহ।

 

ভাদ্র (মধ্য আগস্ট-মধ্য সেপ্টেম্বর):

  • আগাম রবি সবজি যেমন বাঁধাকপি, ফুলকপি, ওলকপি, টমেটো, বেগুন, কুমড়া, লাউ-এর জমি তৈরি, চারা রোপণ, সার প্রয়োগ।
  • মধ্যম ও নাবী রবি সবজির বীজতলা তৈরি ও বীজ বপন।
  • নাবী খরিফ-২ সবজি সংগ্রহ ও বীজ সংরক্ষণ।
  • আগে লাগানো ফলের চারার পরিচর্যা, উন্নত চারা বা কলম লাগানো, খুঁটি দেয়া, বেড়া দিয়ে চারাগাছ সংরক্ষণ, ফল সংগ্রহের পর গাছের অঙ্গ ছাটাই।

 

আশ্বিন (মধ্য সেপ্টেম্বর-মধ্য অক্টোবর):

  • আগাম রবি সবজির চারা রোপণ, পরিচর্যা, সেচ, সার প্রয়োগ, বালাই দমন।
  • নাবী রবি সবজির বীজতলা তৈরি, বীজ বপন।
  • আগাম টমেটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ওলকপির আগাছা দমন।
  • শিম, লাউ, বরবটির মাচা তৈরি ও পরিচর্যা।
  • রসুন, পেঁয়াজের বীজবপন, আলু লাগানো।
  • ফল গাছের গোড়ায় মাটি দেয়া, আগাছা পরিষ্কার ও সার প্রয়োগ।

 

কার্তিক (মধ্য অক্টোবর-মধ্য নভেম্বর):

  • আলুর কেইল বাঁধা ও আগাম রবি সবজির পরিচর্যা ও সংগ্রহ।
  • মধ্যম রবি সবজির পরিচর্যা, সার প্রয়োগ ও সেচ।
  • নাবী রবি সবজির চারা উৎপাদন, জমি তৈরি ও চারা লাগানো।
  • বাঁধাকপি, ফুলকপি, ওলকপির গোড়া বাঁধা ও আগাছা পরিষ্কার।
  • মরিচের বীজবপন ও চারা রোপণ।
  • ফল গাছের পরিচর্যা, সার প্রয়োগ ও মালচিং।

 

অগ্রহায়ণ (মধ্য নভেম্বর-মধ্য ডিসেম্বর):

  • মিষ্টি আলুর লতা রোপণ ও পূর্বে রোপণকৃত লতার পরিচর্যা।
  • পেঁয়াজ, রসুন ও মরিচের চারা রোপণ, আলুর জমিতে সার প্রয়োগ ও সেচ।
  • অন্যান্য রবি ফসল যেমন ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, ওলকপি, শালগম এর পরিচর্যা, সার প্রয়োগ, সেচ ও সংগ্রহ।
  • ফল গাছের মালচিং ও পরিমিত সার প্রয়োগ।

 

পৌষ (মধ্য ডিসেম্বর-মধ্য জানুয়ারি):

  • আগাম ও মধ্যম রবি সবজির পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন ও সবজি সংগ্রহ।
  • নাবী রবি সবজির পরিচর্যা ও ফল গাছের পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন।
  • বাণিজ্যিকভাবে মৌসুমি ফুল চাষের জন্য ফুল গাছের যত্ন ও সারের উপরি প্রয়োগ।

 

মাঘ (মধ্য জানুয়ারি-মধ্য ফেব্রুয়ারি):

  • আলু, পেঁয়াজ, রসুনের গোড়ায় মাটি তুলে দেয়া, সেচ, সার প্রয়োগ।
  • টমেটোর ডাল ও ফল ছাটা, মধ্যম ও নাবী রবি সবজির সেচ, সার, গোড়া বাঁধা ও মাচা দেয়া।
  • আগাম খরিফ-১ সবজির বীজতলা তৈরি, মাদা তৈরি ও বীজ বপন।
  • সুস্থ সবল ও রোগমুক্ত চারা রোপণ।

 

ফাল্গুন (মধ্য ফেব্রুয়ারি-মধ্য মার্চ):

  • নাবী খরিফ-১ সবজির বীজতলা তৈরি, মাদা তৈরি ও বীজ বপন।
  • আগাম খরিফ-১ সবজির চারা উৎপাদন ও মূল জমি তৈরি, সার প্রয়োগ ও রোপণ।
  • আলু, মিষ্টি আলু সংগ্রহ, রবি সবজির বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ।
  • ফল গাছের গোড়ায় রস কম থাকলে সেচ প্রদান, পোকা-মাকড় ও রোগবালাই দমন।

 

চৈত্র (মধ্য মার্চ-মধ্য এপ্রিল):

  • গ্রীষ্মকালীন বেগুন, টমেটো, মরিচের বীজবপন বা চারা রোপণ।
  • নাবী জাতের বীজতলা তৈরি ও বীজ বপন।
  • সবজি ক্ষেতের আগাছা দমন, সেচ ও সার প্রয়োগ।
  • কুমড়া জাতীয় সবজির পোকা-মাকড় ও রোগবালাই দমন।
  • নাবী রবি সবজি উত্তোলন, বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ।

 

উপসংহার

বাংলাদেশে বারোমাসি চাষাবাদ সম্ভব বলে আমাদের খাদ্য তালিকায় সারা বছরই পুষ্টিকর সবজি ও ফল রাখতে পারি। সঠিক সময়ে সঠিক ফসল চাষ করে আমরা নিজেদের এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি। 

তাই প্রতিটি কৃষকের উচিত সময় অনুযায়ী চাষাবাদ করা এবং আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ফলমূল রাখার চেষ্টা করা।

 

৫টি সাধারণ প্রশ্ন

  1. কোন মাসে আম চাষ করা উচিত?
    • বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে আম চাষ করা হয়।

 

  1. কলা সারা বছর পাওয়া যায় কেন?
    • কলা বিভিন্ন মৌসুমে চাষ করা যায় এবং এটি সংরক্ষণ করা সহজ।

 

  1. লিচু কোন অঞ্চলে বেশি চাষ করা হয়?
    • দিনাজপুর অঞ্চলে লিচু বেশি চাষ করা হয়।

 

  1. আম কেন স্বাস্থ্যের জন্য ভালো?
    • আমে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, এ, এবং ই রয়েছে যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

 

  1. ফলমূল খেলে কীভাবে আমাদের স্বাস্থ্য উপকারিতা হয়?
    • ফলমূল আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে, হজমশক্তি বাড়ায়, ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।